মধু সংগ্রহ ও সংরক্ষণ

মধু সংগ্রহ ও সংরক্ষণ
বস্তুনিরপেক্ষ
গ্রামীণ অর্থনীতি উন্নয়নের ক্ষেত্রে মৌমাছি পালনকে অনেক দেশে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। এর ধারাবাহিকতায় আমাদের দেশে ১৯৫৮ সালে সর্বপ্রথম মৌচাষের সূচনা হয় এবং ১৯৬৩ সালে বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প কর্পোরেশন (বিসিক) এর মাধ্যমে জনগণকে মৌমাছি পালনের প্রশিক্ষণ দেওয়া শুরু হয়। মধু একটি মিষ্টি, আঠালো তরল পদার্থ এর প্রধান উপাদানগুলো হলো কার্বোহাইড্রেট (গ্লুকোজ ও ফ্রুক্টোজ), পানি, প্রোটিন, এনজাইম, এসিড ও খনিজ উপাদান। উচ্চ তাপমাত্রা, বেশি আর্দ্রতা, ভেজাল, দুর্বল প্যাকেজিং এবং দুর্বল স্টোরেজ এর কারণে মধুর মানের অবনতি হয়।
মধু সংগ্রহ
আমাদের দেশে পাঁচ প্রজাতির মৌমাছি দেখা যায়-
১/ এপিস মেলিফেরা
২/ এপিস সেরেনা
৩/ এপিস ডরসাটা
৪/ এপিস ফ্লোরিয়া
৫/ এপিস ট্রাইগোনা
আমাদের দেশের মৌচাষিরা মেলিফেরা ও সেরেনা প্রজাতির মৌমাছির মাধ্যমে মধু সংগ্রহ করে থাকেন। তবে, খামার থেকে প্রাপ্ত মধুর প্রায় ৯০ ভাগ আসে মেলিফেরা মৌমাছি থেকে।
মৌবক্স থেকে মধু সংগ্রহের আগে মৌচাষিদের অবশ্যই নিশ্চিত থাকতে হবে যে, মধুতে সঠিক আর্দ্রতা রয়েছে কিনা। মধু সংগ্রহের আগে আর্দ্রতার স্বরটি বিবেচনা করা গুরুত্বপূর্ণ। মধুতে পানির পরিমাণ হলো- মধু তাজা থাকার ক্ষমতা নির্ধারণ এবং গাঁজন (Fermentation) দ্বারা সৃষ্ট ক্ষতিসাধন নির্ধারণ মাত্রা। আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত যে, উচ্চ মানের মধুতে ২০% এর কম আর্দ্রতা থাকতে হবে। মধু নিষ্কাশনের সময় নিকটবর্তী হওয়ার সাথে সাথে মৌমাছি পালনকারীদের মধুতে কি পরিমাণ পানি আছে তা জানা প্রয়োজন (রিফ্রাকটোমিটার এর সাহায্যে)। মধুর আর্দ্রতার পরিমাণ ২০% এর ভেতর থাকলে তা সংগ্রহ করা। তবে সুন্দরবনের মৌ বাক্সের মধু (বাংলাদেশের একমাত্র অর্গানিক মধু) সংগ্রহের ক্ষেত্রে সর্বাধিক ক্যাপিং বিবেচনা করতে হবে।
পুষ্পরস বা নেক্টার হলো এমন একটা দ্রবন (Solution) যাতে দ্রব (Solute) হিসাবে সুক্রোজ (প্রাকৃতিক চিনি), দ্রাবক (Solvent) হিসেবে পানি থাকে। মৌমাছিরা ফুল থেকে সংগৃহীত নেক্টার পরিবহনের সময় সুক্রোজ-দুটি সহজ শর্করাতে অর্থাৎ মনোস্যাকারাইডে বিভক্ত হয় (গ্লুকোজ ও ফ্রুক্টোজ)। মৌমাছি যখন মধু (Honey Stomach হতে) চাকে রাখে তখন কর্মী মৌমাছিরা তাদের ডানাগুলি দিয়ে বাতাস দেয় যাতে তাপ উৎপন্ন হয় এবং মধুর সাথে মিশ্রিত অতিরিক্ত পানি বাষ্পীভূত হয়, ফলে মধু আঠালো ও ঘন হয়। কর্মী মৌমাছিরা তখন কম আর্দ্রতার মাত্রা ধরে রাখতে মধুকে মোম দিয়ে ক্যাপ বা সীল করে দেয়।
মধু নিষ্কাশনের সময় হাতে গ্লাভস, এস এস দ্বারা নির্মিত ছুরি এবং মধু নিষ্কাশন যন্ত্রপাতি ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। ফুড গ্রেড প্লাস্টিকের ড্রামে মধু সংগ্রহের পূর্বে ড্রাম পরিষ্কার, গন্ধ মুক্ত, জীবাণু মুক্ত ও শুষ্ক আছে কি না তাও নিশ্চিত হওয়া প্রয়োজন।
কম আর্দ্রতা, অ্যান্টিব্যাকটেরিয়াল এবং অ্যাসিডিক বৈশিষ্ট্যগুলির কারণে মধু মূলত অনেক দিন ভালো থাকে। মধু তখন নষ্ট হবে যখন আপনি এটাকে ভুলভাবে সংরক্ষণ করবেন।
মধু সংরক্ষণ
(ক) সঠিক পাত্রের ব্যবহারঃ আপনি যখন বোতলজাত মধু ক্রয় করবেন তখন দেখবেন মধু আসল পাত্রে রাখা আছে কিনা অর্থাৎ কাচ বা ফুড গ্রেড প্লাস্টিকের পাত্রে আছে কিনা। মধু যেহেত অম্লীয় তাই মধুকে ধাতব পাত্রে রাখা যাবে না। পাত্রের মুখ এমন ভাবে সীল করা প্রয়োজন যাতে কোন রকম বাতাস মধুর সংস্পর্শে না আসে কারণ মধু বাতাস হতে আর্দ্রতা শোষণ করে।
(খ) কক্ষ তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ: আমাদের দেশের প্রায় সবগুলো মধুতে গ্লুকোজ বেশি থাকায় (ফুলের কারণে) ১০° থেকে ২১° সেলসিয়াস তাপমাত্রায় মধু জমে (Crystal) যাওয়ার প্রবণতা বেশি থাকে। উপরোক্ত তাপমাত্রায় মধুর মনোস্যাকারাইড এর আন্তঃআনবিক দূরত্ব কমে যায় এবং গ্লুকোজ পানিতে কম দ্রবণীয় হওয়ার কারনে মধু জমে যায়। সহজ করে বললে- মধু জমতে এর মধ্যে বিদ্যমান আর্দ্রতা, তাপমাত্রা, উৎসের উপর নির্ভর করে। পৃথিবীর প্রায় সকল দেশের মধুর জমার প্রবণতা আছে কারণ ইহা অতিসম্পৃক্ত দ্রবণ। আমাদের দেশের সুন্দরবনের মধু ছাড়া যে কোন একক ফুলের (নামের) মধু জমে যাওয়ার প্রধান কারণ অল্প আর্দ্রতা, বেশি গ্লুকোজ এবং কম তাপমাত্রার উপস্থিতি। যেহেতু সুন্দরবন এর মধুতে গ্লুকোজ এর পরিমান কম এবং পানির পরিমান বেশি থাকে তাই এ মধু সাধারণত জমতে কম দেখা যায়।
কক্ষ তাপমাত্রায় অপেক্ষাকৃত ঠান্ডা ও শুষ্ক জায়গায় মধু রাখা যাহাতে মধু সরাসরি সূর্যের আলো থেকে দূরে থাকে কারণ এতে মধুর রং কালচে হতে শুরু করে যা মধুর স্বাদ ও গন্ধের পরিবর্তন ঘটায়। ‘মধু’ রান্নার চুলা বা ওভেনের পাশে না রাখা। ফ্রিজে মধু সংরক্ষণ করলে তা দ্রুত জমার সম্ভাবনা থাকে। অনেকে জমা মধু খাওয়া পছন্দ করে না যদিও জমে যাওয়া মধুর গুণগত মানের কোন পরিবর্তন ঘটে না।
(গ) আদ্রতা বা পানির উপস্থিতি: মধুর আর্দ্রতা ২০% এর নিচে থাকতে হবে এবং শুষ্ক স্থানে সংরক্ষণ করতে হবে। মনে রাখতে হবে মধুতে সবচেয়ে ক্ষতিকারক উপাদান হলো অধিক আর্দ্রতা। যদি মধু দ্রুত জমা শুরু হয় তবে স্ফটিক বা দানাগুলো নরম ও ছোট হবে আর যদি জমার গতি ধীরে হয় তবে স্ফটিকগুলো শক্ত ও বড় হবে যা মধুতে বিদ্যমান আর্দ্রতা ও গ্লুকোজের উপর নির্ভর করে। জমে যাওয়া মধু ১৫ মিনিট (পাত্রসহ) গরম পানিতে রাখুন, দেখবেন মধু আস্তে আস্তে তরলে পরিণত হবে। পূর্বে উল্লিখিত হিসাবে, তাপ মধুর সবচেয়ে খারাপ শত্রু, তাই গরম পানি ব্যবহারের ক্ষেত্রে ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে রাখা কোন মতে তা ৫৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস এর বেশি না হওয়া কারণ এতে মধুর গুণগত মান কমতে শুরু করে। মধুতে চামচ ব্যবহারের পূর্বে এটি শুকনো হওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করুন। যদি মধুতে অল্প পরিমাণে পানি মিশ্রিত হয় তাহলে আপনার ব্যবহৃত মধুর গুণগত মানকে হ্রাস করতে পারে।
পরিশেষেঃ বেশি আর্দ্রতার মধু উচ্চ তাপমাত্রায় প্রক্রিয়াজাত করলে এতে হাইড্রোক্সিল মিথাইল ফুরফুরাল (HMF) তৈরি হয় যা শরীরের সহনীয় পর্যায়ের (মানবদেহে HMF এর সহনীয় সীমা প্রতি কেজি মধুতে ৪০ মিলি গ্রাম) চেয়ে বেশি হবে এবং আমাদের স্বাস্থ্যের ক্ষতির কারণ হবে। সুতরাং কাচা মধু ও প্রক্রিয়াজাত মধু সংগ্রহ ও সংরক্ষণের ক্ষেত্রে তাপমাত্রা, আদ্রতা এবং সঠিক পাত্রের ব্যবহার নিশ্চিত করা প্রত্যেক মৌচাষি, ব্যবসায়ী এবং ভোক্তা সকলের জন্য জরুরী।
সৈয়দ জাহিদুর রাহমান
(প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক, তাসকান)