মধু কেন জমে যায়?

মধু জমে কেন?
মধু একটি দ্রবন। আমরা জানি দ্রবন তিন প্রকার যথা-১/ অসম্পৃক্ত ২/ সম্পৃক্ত ৩/ অতিপৃক্ত, মধু একটি অতিপৃক্ত দ্রবন। আর এই অতিপৃক্ত দ্রবনে, দ্রব্য হিসেবে থাকে গ্লুকোজ ও ফ্রুকটোজ এবং দ্রাবক হিসেবে থাকে পানি। গ্লুকোজ ও ফ্রুকটোজের আনাবিক সংকেত (C6H12O6) একই। গ্লুকোজ ও ফ্রুকটোজে যথাক্রমে একটি এলডিহাড (-CHO) ও একটি কিটোন (=CO) রয়েছে। গ্লুকোজ কার্বন-কার্বন একক বন্ধনে দুটি হাইড্রোক্সিল (-OH) মূলক পানি বের করে দিয়ে কার্বনিল মূলকে রুপান্তরিত হওয়ার প্রবনতা দেখায়। মধুর দ্রবনে গ্লুকোজ Unstable থাকে তাই সে কার্বনিল মূলকে রুপান্তরিত হয়ে Stable হতে চায়। গ্লুকোজের Stable হওয়ার প্রবনতা থেকে মধু Crystal Form করতে শুরু করে।
আমরা জানি, সুক্রোজ বা চিনির তুলনায় গ্লুকোজ পানিতে কম দ্রবনীয়। সহজ করে বললে- কোনো নির্দিষ্ট তাপমাত্রায় কোনো নির্দিষ্ট দ্রাবকে যে পরিমান দ্রব্য দ্রবীভূত হয়ে সম্পৃক্ত দ্রবন তৈরি করে তাকে ঐ দ্রাবকে ঐ দ্রব্যের দ্রাব্যতা বলে। আর দ্রাব্যতা-তাপমাত্রা, দ্রাবকের পরিমান ও চাপের উপর নির্ভও করে। যেখানে ও তাপমাত্রায় ১০০ গ্রাম পানিতে চিনি দ্রবীভূত হতে পারে ১৮০ গ্রাম।
সেখানে,
২৫°C তাপমাত্রায় ১০০ গ্রাম পানিতে গ্লুকোজ দ্রবীভূত হয় ৯১ গ্রাম
৩০°C তাপমাত্রায় ১০০ গ্রাম পানিতে গ্লুকোজ দ্রবীভূত হয় ১২৫ গ্রাম
৫০°C তাপমাত্রায় ১০০ গ্রাম পানিতে গ্লুকোজ দ্রবীভূত হয় ২৪৪ গ্রাম
৭০°C তাপমাত্রায় ১০০ গ্রাম পানিতে গ্লুকোজ দ্রবীভূত হয় ৩৫৭ গ্রাম
এ থেকে আমরা বুঝতে পারলাম তাপমাত্রা বৃদ্ধির সাথে সাথে দ্রাবকে দ্রব্যের দ্রবনীয় হওয়ার ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়।
অপর দিকে তাপমাত্রা কমলে সেই ক্ষমতা হ্রাস পায়।
শুরুতে বলেছিলাম মধু একটি অতিপৃক্ত দ্রবন সুতরাং এখানে দ্রাবক বা পানি কম থাকে।
যেহেতু দ্রাবক কম থাকে এবং গ্লুকোজের কার্বনিল মূলকে রুপান্তরিত হওয়ার প্রবনতা থাকে তাই তাপমাত্রা কম বা বেশী হলে
দ্রবনের উপর প্রভাব পড়ে। যেমন আমাদের দেশে সরিষা ফুলের মধুতে গ্লুকোজ বেশী থাকে এবং দ্রাবক বা পানি কম থাকে এবং সংগ্রহ কালীন তাপমাত্রা ২০°C/২১°C এর নিচে থাকে বিধায় এই মধু দ্রুত জমে যায়। অপর দিকে সুন্দরবনের মধুতে গ্লুকোজ কম ও দ্রাবক বা পানির পরিমান বেশী থাকে বিধায় তাকে সাধারনত জমতে দেখা যায় না। যদিও মধু জমার পেছনে আরো কিছু নিয়ামক কাজ করে যেমন- বি পোলেন, ইয়ার বাবল, বি পার্টিকেল, মোম ইত্যাদি।
উপরোক্ত আলোচনায় আমরা মধু জমার তিনটি প্রধান কারনে পেয়েছি।
১। গ্লুকোজ কার্বন-কার্বন একক বন্ধনে দুটি হাইড্রোক্সিল (-OH) মূলক পানি।
বের করে দিয়ে কার্বনিল মূলকে রুপান্তরিত হওয়ার প্রবনতা।
২। গ্লুকোজের দ্রাব্যতা যা তাপমাত্রার উপর নির্ভর করে থাকে।
৩। দ্রাবকের পরিমান যা গ্লুকোজের দ্রব্যতার মানের পরিবর্তন ঘটায়।
বাংলাদেশর কোন কোন মধু জমে যায় চলুন জানা যাক –
সরিষা ফুলের মধু :
বাংলাদেশে সর্বোচ্চ উৎপাদিত মধু সরিষা ফুলের মধু।
যখন চাক থেকে মধু সংগ্রহ করা হয় তখন ঘ্রাণ কিছুটা সরিষা ফুলের মত মনে হয়।এই মধুতে গ্লুকোজ এর আধিক্য থাকায় ঠান্ডায় দ্রুত জমে যায়। মধুর আদ্রতাএবং তাপমাত্রার কম বেশির কারনে মধু জমে যাওয়া ধীরে অথবা দ্রুত হতে দেখা যায়।
জমে যাওয়া এই মধুকে ক্রিস্টাল হানি বা দানাদার মধু বলে।
লিচু ফুলের মধু :
বাংলাদেশে দ্বিতীয় বৃহত্তম উৎপাদিত মধু হচ্ছে লিচু ফুলের মধু।
যার স্বাদ ও ঘ্রান লিচু ফলের স্বাদ ঘ্রাণ এর সাথে মিলে যায়।এই মধু সরিষা ফুলের মধুর তুলনায় কম জমে।
ধুনিয়া ফুলের মধু :
ধুনিয়া মসলার চমৎকার ঘ্রাণ ও স্বাদ রয়েছে এই মধুতে। আদ্রতা ও তাপমাত্রার কারনে আংশিক অথবা কখনো সম্পূর্ণ জমে যেতে পারে।
কালোজিরা ফুলের মধু :
কালোজিরা ফুলের মধুর ভেষজগুন উল্লেখ করার মতো। এই মধু সাধারণত জমতে দেখা যায় না। তবে কালোজিরা ফুলের নেক্টারের সাথে ধুনিয়া ফুলের নেক্টারের মিশ্রণ বেশি হলে তা জমতে দেখা যায়।
বরই ফুলের মধু :
বরই ফুলের মধু সাধারণত জমতে দেখা যায় না কারন এর আদ্রতা ২৩% এর উপরে থাকে।এই ধরনের মধু ৪ মাসের মধ্যে খেয়ে ফেলা উত্তম। তবে ২৩% আদ্রতার যে কোন মধু ২ বছর পর্যন্ত মেয়াদ দিয়ে বিক্রির অনুমতি দেয় বিএসটিআই।
সুন্দরবনের মধু:
প্রাকৃতিক চাকের মধু সংগ্রহের বড় উৎস ম্যানগ্রোভ সুন্দরবন। সুন্দরবন এর মধু সাধারণত জমে না।এই মধুতে গ্লুকোজ এর তুলনায় ফ্রুকটোজ বেশি থাকে এবং আদ্রতা ২২ থেকে ২৭% পর্যন্ত হয়ে থাকে।কেবলমাত্র সর্বোচ্চ ২৫% আদ্রতার সুন্দরবনের র মধু বিক্রির অনুমতি প্রদান করে বিএসটিআই।
গ্রামীণ চাকের মধু :
ডিসেম্বর থেকে এপ্রিল এর আগ পর্যন্ত গ্রামীণ চাকের যে মধু পাওয়া যায় তা জমতে দেখা যায়। কারন এসময় যে ফুল ফোটে তার নেক্টারে গ্লুকোজ বেশি থাকায় তা জমে যায় কিন্তু এপ্রিল থেকে নভেম্বর পর্যন্ত গ্রামীণ প্রাকৃতিক চাকের যে মধু পাওয়া যায় এর আদ্রতা ২৫% থেকে কখনো কখনো ৩০% হতে দেখা যায়। উচ্চ আদ্রতার এই মধুও জমে না।
এই ধরনের মধু ২ থেকে ৩ মাসের মধ্যে খেয়ে ফেলার পরামর্শ দেন বিভিন্ন গবেষকগন।
সৈয়দ জাহিদুর রহমান
(প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক, তাসকান)